
– মিথুন বড়ুয়া
শিক্ষা প্রতিটি রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। সেই ভিত্তি কেমনভাবে নির্মিত হবে, তার ওপরই নির্ভর করে সমাজ কোন পথে এগোবে। বিশ্বজুড়ে শিক্ষা সাধারণত দুটি প্রধান ধারায় পরিচালিত হয়— ট্রেডিশনাল (Traditional) ও ভোকেশনাল (Vocational)।
এই দুই ধারার উদ্দেশ্য আলাদা হলেও একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই দুই ধারার সীমারেখা আজ প্রায় মুছে গেছে। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এক বিভ্রান্ত ও জগাখিচুড়ি অবস্থায় আটকে আছে।
—
🔹 ট্রেডিশনাল শিক্ষা: গবেষণাভিত্তিক চিন্তার চর্চা
ট্রেডিশনাল শিক্ষা মূলত উচ্চতর চিন্তা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা ও গবেষণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
এখানে লক্ষ্য থাকে— জ্ঞান সৃষ্টি, যুক্তিবোধের বিকাশ এবং সামাজিক চিন্তার পরিশুদ্ধি।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জ্ঞান ও গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু তথ্য শিখে না, বরং নতুন তথ্য সৃষ্টি করে।
কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন।
এখানে শিক্ষা এখন মুখস্থ নির্ভর, পরীক্ষাকেন্দ্রিক ও চাকরিমুখী।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ধীরে ধীরে গবেষণার কেন্দ্র না হয়ে সার্টিফিকেট উৎপাদনের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে।
চিন্তা, বিশ্লেষণ ও নতুন ধারণা সৃষ্টির জায়গা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে প্রতিযোগিতার চাপে।
—
🔹 ভোকেশনাল শিক্ষা: কর্মদক্ষতার বাস্তব প্রয়োগ
অন্যদিকে, ভোকেশনাল শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো শিক্ষা ও কর্মের মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন।
এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়— দক্ষতা উন্নয়ন, হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জনে।
যেসব দেশ শিল্প, প্রযুক্তি ও উৎপাদনমুখী অর্থনীতি গড়ে তুলেছে, তারা ভোকেশনাল শিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের অংশ করেছে।
কিন্তু বাংলাদেশের ভোকেশনাল শিক্ষার অবস্থাও তেমন উজ্জ্বল নয়।
বেশিরভাগ টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে রয়েছে আধুনিক সরঞ্জামের অভাব, প্রশিক্ষকের স্বল্পতা, আর কার্যকর বাস্তব প্রশিক্ষণের ঘাটতি।
ফলে শিক্ষার্থীরা তত্ত্ব শিখলেও বাস্তব দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
—
🔹 এক জগাখিচুড়ি বাস্তবতা
আজ বাংলাদেশের শিক্ষা এক অদ্ভুত মিশ্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
স্কুলে শেখানো হয় এমন তত্ত্ব যা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরের,
আর বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো হয় এমন বিষয় যা স্কুল পর্যায়ের মুখস্থভিত্তিক।
ভোকেশনাল শিক্ষার্থীরা ‘প্র্যাকটিক্যাল’ শব্দেই ভয় পায়,
আর ট্রেডিশনাল শিক্ষার্থীরা ‘গবেষণা’ বলতে বোঝে থিসিস বইয়ের কপি-পেস্ট।
রাষ্ট্রীয় নীতিতেও নেই সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা।
আমরা কি জ্ঞানভিত্তিক গবেষণামুখী রাষ্ট্র হতে চাই,
না কি কর্মদক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দেশ হতে চাই—
এই প্রশ্নের উত্তর এখনো স্পষ্ট নয়।
—
🔹 শিক্ষা নয়, সার্টিফিকেটের প্রতিযোগিতা
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় জ্ঞানের চেয়ে সার্টিফিকেট বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
শিক্ষক পড়ান পরীক্ষায় পাস করানোর জন্য, শিক্ষার্থী শেখে চাকরির জন্য,
আর অভিভাবক চান— যেভাবেই হোক একটা ভালো চাকরি।
এই মানসিকতা শিক্ষা থেকে মানবিকতা, চিন্তাশক্তি ও সৃষ্টিশীলতাকে সরিয়ে দিয়েছে।
—
🔹 শেষ কথা
শিক্ষা যদি হয় চিন্তার জন্মভূমি, তবে কর্মশিক্ষা সেই চিন্তার বাস্তব রূপ।
একটি রাষ্ট্র তখনই এগিয়ে যায়, যখন সে এই দুই ধারার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন এখন—
এই জগাখিচুড়ি অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা ও দিকনির্দেশনা তৈরি করা।
যেখানে ট্রেডিশনাল ও ভোকেশনাল— দুই শিক্ষা ধারাই একে অপরের পরিপূরক হয়ে
সমাজ ও রাষ্ট্রের টেকসই অগ্রগতির পথ দেখাবে।