
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভাষণ চলাকালীন ইসরায়েলের কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত দুই আইনপ্রণেতা—আয়মান ওদেহ ও ওফের কাসিফ—‘Recognise Palestine!’ (ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিন!) লেখা প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে ধরেন। নিরাপত্তারক্ষীরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের কনেসেট থেকে টেনে বের করে দেন। এ সময় ডানপন্থি জোটের সংসদ সদস্যরা ‘Trump! Trump! Trump!’ স্লোগান দিতে থাকেন।
ওদেহ হলেন ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট ফর পিস অ্যান্ড ইকুয়ালিটির (হাদাশ) চেয়ারম্যান—একটি আরব-ইহুদি যৌথ রাজনৈতিক জোট, যা দুই রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে এবং ইসরায়েলের দখলদার নীতির বিরোধী। অন্যদিকে, ওফের কাসিফ কনেসেটের একমাত্র ইহুদি কমিউনিস্ট সদস্য। পশ্চিম তীরে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের সমালোচনার কারণে তিনি একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছেন ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের মুখে পড়েছেন।
কাসিফ পরে গণমাধ্যমে বলেন, ‘ট্রাম্প কনেসেটে এসেছিলেন এক আত্মপ্রশংসামূলক বিজয় বক্তৃতা দিতে—যেখানে বাস্তবতা ও নৈতিকতার কোনো স্থান ছিল না। গাজার যুদ্ধবিরতি অর্জনে তার কোনো কৃতিত্ব নেই; বরং তার নীতিই গাজায় হত্যাযজ্ঞ দীর্ঘায়িত করেছে।’ কাসিফ স্মরণ করিয়ে দেন, ‘ট্রাম্প নিজেই বলেছিলেন: ‘তুমি এক-দেড় মিলিয়ন লোকের (গাজার বাসিন্দা) কথা বলছ, আর পুরো জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেলছ।’ আবার বলেছিলেন, ‘আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজার মানুষদের স্থায়ীভাবে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে এবং তারা আর কখনো ফিরে আসতে পারবে না।’
“তিনি আরও হুমকি দিয়েছিলেন যে ‘গাজার ওপর নরকের দ্বার খুলে দেওয়া হবে।’ এই হত্যাকারী সরকারের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থনের মাধ্যমে তিনি শুধু গণহত্যা চালিয়ে যেতে দেননি, বরং জিম্মিদের অবহেলাও অব্যাহত রেখেছেন।”
ট্রাম্প নিজেই স্বীকার করেন যে, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান মার্কিন সহায়তা ও অনুমোদন ছাড়া সম্ভব হতো না। ওদেহ আর কাসিফের কথাগুলো সেই মানবিকতার প্রতি আবারও ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যেখানে দেখা যায় ইসরায়েল রাষ্ট্রের মধ্যে এখনো মানবিক ও নৈতিক কণ্ঠস্বর বিদ্যমান, যারা সহিংসতা ও আগ্রাসনের বিরোধিতা করতে সাহস রাখে।
মিশরে মধ্যস্থতাপূর্ণ যুদ্ধবিরতির চিত্রটিও ছিল এক নাটকীয় দৃশ্য। হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি ও ইসরায়েলের কারাগার থেকে ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিনিময়, দীর্ঘদিন পর গাজায় এক ঝলক আশার আলো ফিরিয়ে আনে। বন্দিরা স্বজনদের বুকে ফিরে আসে, গাজার ধ্বংসস্তূপে মানুষ নতুন করে বসতি স্থাপনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
চুক্তি স্থাপনের প্রধান সসমন্বয়কারী হিসেবে ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার দাবি করেন, তাঁদের ‘স্টেপ-বাই-স্টেপ’ কৌশলই এই সফলতার মূল। কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানি একে সমর্থন করে বলেন, ‘যদি আমরা সব বিষয় একসঙ্গে আলোচনায় আনতাম, চুক্তি হতো না।’
কিন্তু যুদ্ধবিরতির পরদিনই ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিতে কয়েকজন ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয় এবং নতুন করে গ্রেফতার অভিযান চালায় তারা। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে—এই যুদ্ধবিরতি কতটা টেকসই?
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: ‘অসলো’ চুক্তির প্রতিধ্বনি?
এই চুক্তিকে অনেকেই তুলনা করছেন ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির সঙ্গে, যা ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (PLO) মধ্যে শান্তির প্রথম আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ ছিল। তখনও মূল প্রশ্নগুলো—জেরুজালেমের মর্যাদা, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের অধিকার, স্থায়ী সীমানা ও বসতি স্থাপন—‘পরবর্তীতে আলোচনার জন্য’ রেখে দেওয়া হয়েছিল। ফলাফল হিসেবে চুক্তি ভেস্তে যায়, আর সংঘাত নতুন রূপে ফিরে আসে।
২০২৫ সালের এই মিশর চুক্তিও একই পথে হাঁটছে কি না, সেই প্রশ্ন আজ উঠছে। কারণ ইসরায়েল এখনো বলছে—হামাসকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ না করলে স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়। অর্থাৎ যুদ্ধ থেমেছে, কিন্তু রক্তক্ষরণ থামেনি।
এই যুদ্ধবিরতি নিঃসন্দেহে মানবিক স্বস্তির একটা অধ্যায়। কিন্তু যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়া হয়, যদি ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে স্থায়ী সমাধান না আসে, তবে এও হয়ে উঠতে পারে আরেকটি ‘অসলো’—যেখানে শান্তির স্বপ্ন কেবল কাগজেই থেকে যাবে, আর বাস্তবে চলবে দখল, অবরোধ ও সহিংসতার নিরন্তর ধ্বংসযজ্ঞ।
লেখক : বৃটেনপ্রবাসী কলামিস্ট।